স্মৃতিতে সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী লঞ্চঘাট
- আপলোড সময় : ০৯-০৩-২০২৫ ১১:৩৯:৩৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৯-০৩-২০২৫ ১১:৩৯:৩৩ অপরাহ্ন

আকরাম উদ্দিন ::
লঞ্চযাত্রী ও প্রকৃতিপ্রেমিদের আগমনে গভীর রাতেও জেগে থাকে সুনামগঞ্জ শহরের ঐতিহ্যবাহী লঞ্চঘাট। তার এই জেগে থাকা দীর্ঘ কালের। এখানে এসে আঁকাবাঁকা সুরমার মনোরম পরিবেশে মনের গভীর থেকে এক অজানা প্রেমের ছোঁয়ায় মাতোয়ারা হয়ে উঠেন প্রকৃতিপ্রেমিরা। লঞ্চঘাটে এখনও বিশিষ্টজনদের সমাগম ঘটে প্রতিনিয়ত। কেউ সুরমা নদীর সৌন্দর্য্য উপভোগ করেন, কেউ আবার গোধূলি সন্ধ্যায় অস্তমিত রবিকে বিদায়ী সম্ভাষণ জানান নীরবে দাঁড়িয়ে। কেউ আবার পূর্বাকাশের অদূরে সোনালী রূপে উদিত পূর্ণিমার চাঁদ দেখে মনকে উড়িয়ে দেন আকাশে। যেন এক স্বপ্নীল ভুবনে নিজেকে নিবেদিত করেন নিমিষেই। মোহ মুহূর্তের সন্ধান খোঁজে বেড়ান প্রেমিকেরা। অন্তর্নিহিত স্বপ্নীল ভুবনে খুঁজে পান তাঁরা মনের মানুষকে। দিনের শেষে বিশ্রামের সময়টুকু কাটিয়ে দেন লঞ্চঘাটে। এ যেন অনন্ত প্রেমের বন্ধন।
এই শহরের কালের সাক্ষী হয়ে আছে লঞ্চঘাট। এ নিয়েই স্মৃতিচারণ চলে প্রতিদিন। এই লঞ্চঘাটে দাঁড়ালেই স্মরণ হয় ইতিহাস-ঐতিহ্য, ফেলে আসা দিনগুলো। ইতিহাস বলে দেয় কত শত কল্পকাহিনী আর সুখ-দুঃখ ঘটনার বিবরণ।
লঞ্চঘাটের সূচনা :
ব্রিটিশ শাসনামলে এই শহরের সুরমা মার্কেট এলাকায় নদীর তীরে ছিল স্টিমারঘাট। তখন এই ঘাটেই স্টিমার ভিড়তো বলেই লোকমুখে স্টিমারঘাট নাম প্রচারিত হয়। স্টিমারে মালামাল বহনসহ মানুষও আরোহণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেতেন তখন। এক সময় স্টিমার আসা বন্ধ হয়ে যায় সুনামগঞ্জে। এর কিছুদিন পর মানুষ জলপথে যাতায়াতের সুবিধার্থে আসে হাইপ্রিট নামক জলযান। এই হাইপ্রিট কিছুদিন চলাচলের পর বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে লঞ্চের যাত্রা শুরু।
লঞ্চ সার্ভিস শুরু :
স্টিমার ঘাটে জলপথে চলাচলের জন্য আসতে শুরু করে কাঠের তৈরি লঞ্চ। তখন পাকিস্তান শাসনামল। এই স্টিমার ঘাটের আশপাশের এলাকাজুড়ে নদীর ঘাটে ভিড়তো লঞ্চ। মানুষ জেলার বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন এসব লঞ্চে। তখন যাত্রী ও লঞ্চের সংখ্যাও দিনে দিনে বাড়তে থাকে। এসব ঘাটে সিলেট, জামালগঞ্জ ও সাচনা কোম্পানির অনেকগুলো লঞ্চ ভিড়তো। বুরহান এক্সপ্রেস, জালালী, মুন্না, শিবলি এক্সপ্রেস, সাচনা কোম্পানির সাচনা এক্সপ্রেস, আমিনা, সুরমা, জালালাবাদ ও জামালগঞ্জ এক্সপ্রেস নামের এসব লঞ্চ। এই সময়ে আবুল মনসুর আহমদ তালুকদার লাল মিয়া ও রহমান মিয়ার একাধিক লঞ্চও ভিড়তো এসব ঘাটে।
পাক ওয়াটার কো¤পানি :
সিলেট বিভাগের বিভিন্ন কো¤পানির লঞ্চের আগমনের পর পাকিস্তান শাসনামলে পাক ওয়াটার কোম্পানির লঞ্চ আসে সুনামগঞ্জে। দেশের সর্ববৃহৎ কোম্পানি পাক ওয়াটার। এই কো¤পানির কর্তৃপক্ষ সুনামগঞ্জে এসে প্রথমেই লঞ্চের অফিসের স্থায়ী জায়গা নির্ধারণ করেন। তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক নিজাম উদ্দিনের কাছে চাওয়া হয় অফিসের স্থায়ী জায়গা। তখন লঞ্চঘাট এলাকায় রাজগোবিন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের পাশের খালি মাঠ অফিসের কাজে ব্যবহারের জন্য দেন তিনি।
এই অফিসের জায়গা পেয়ে কো¤পানি কর্তৃপক্ষ লঞ্চ ভিড়ানোর জন্য কাঠ দিয়ে পন্টুন তৈরি করেন। অফিসের কার্যক্রম শুরু করেই নিয়ে আসা হয় লঞ্চ। তখন জাহানারা এক্সপ্রেস নামের প্রথম লঞ্চ আসে পাক ওয়াটার কো¤পানির। এই পাক ওয়াটার কোম্পানির লঞ্চ পর্যায়ক্রমে একে একে ২১টি লঞ্চ আসে সুনামগঞ্জে।
বিআইডব্লিটিএ’র পন্টুন স্থাপন :
সুনামগঞ্জে তখন লঞ্চ ও যাত্রী বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি নারায়নগঞ্জ বিআইডব্লিটিএ’র নজরে আসে। তখন বিআইডব্লিউটিএ স্টিলের পন্টুন স্থাপন করে দেয়। সেই সাথে পন্টুনে যাত্রী ও মালামাল উঠানামার জন্য রেল লাইন আদলে পাকা রাস্তা থেকে নদীর পানি পর্যন্ত স্লোপিং ঢালাই করে নির্মাণ করা হয় সিঁড়ি। এই স্লোপিং স্থানেই হুইল সংযুক্ত একটি আধুনিক সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে সিঁড়ি নির্মাণ করায় মালামাল বহন ও যাত্রীদের উঠানামার সুবিধা হতো বেশি। এই সিঁড়ি দিয়ে ভারী মালামাল অটোমেটিক চলে আসতো পাকা রাস্তার মাঝে। লঞ্চ যখন পন্টুনে ভিড়তো, তখন এই সিঁড়ি উপরের দিকে উঠতো, যখন লঞ্চ ছেড়ে যেতো, তখন সিঁড়ি নিচে নেমে যেতো।
সিঁড়ির চাপে দুর্ঘটনা :
সিঁড়ি এমনভাবে উঠানামার সময় সিঁড়ির চাপে পড়ে লাল মিয়া নামের একজনের মৃত্যু হয়েছিল তখন। এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল পাক ওয়াটারের লঞ্চ ভিড়ানোর সময়। অবশ্য লাল মিয়া নামের ওই স্কুল শিক্ষার্থী বেখেয়ালে দাঁড়িয়েছিল সিঁড়ির সামনের দিকে।
স্টিমারঘাট এলাকা থেকে লঞ্চঘাট স্থানান্তর :
বিআইডব্লিউটিএ পন্টুন স্থাপন করার পর তখন লঞ্চঘাট স্থানাস্তর হয়ে আসে পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায়। পাক ওয়াটারের নির্মিত কাঠের পন্টুন বাতিল করে বিআইডব্লিউটিএ’র স্টিলের পন্টুনে পাক ওয়াটারের লঞ্চসহ অন্যান্য কো¤পানির লঞ্চ ভিড়ানো হতো। দেশ স্বাধীনের পর পাক ওয়াটার কোম্পানির নাম পরিবর্তন হয়ে বেঙ্গল ওয়াটার নামকরণ হয়।
যাত্রীদের সেবায় লঞ্চ চলাচলে প্রতিযোগিতা :
লঞ্চ সার্ভিসে যাত্রীদের সুবিধা প্রদান এবং কম সময়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে যাত্রীদের পৌঁছে দেয়ার প্রতিযোগিতা ছিল বেশি। তবে বেঙ্গল ওয়াটার কোম্পানির কয়েকটি লঞ্চ চলতো বেশি বেগে। এরমধ্যে ছিল কাঞ্চনপুর, গোড়াইল, এলাচিপুর, ডাকিজোড়া, পল্টু-১, পল্টু-২। এছাড়াও শরীফপুর এক্সপ্রেস, আজিজ মঞ্জিল, রুমি, মুসাফির, ডায়না, ওয়াহিদ-২, সিনথিকা, রতনা, জাকারিয়া, হান্নান এক্সপ্রেস, নুরুল এক্সপ্রেস, রহিম এক্সপ্রেস, টিপু এক্সপ্রেস, বিশ্বম্ভরপুর এক্সপ্রেস নামের আরও অনেক লঞ্চ ছিল।
তৎকালীন লঞ্চ সার্ভিস পরিচালনার জন্য ছিল কয়েকটি কো¤পানির লঞ্চের অফিস। যাত্রী সাধারণের চাহিদা মেটাতে ছিল পাকা রাস্তা থেকে নদীর তীর পর্যন্ত অর্ধশত দোকান-পাট। এর মধ্যে ছিল ছমাদের দুইতলা হোটেল। হোটেল বয় হাঁকিয়ে বলতো মাছ-ভাত দুই টাকা। ছিল চিটাগাং হোটেল ও তছকির উদ্দিনের হোটেল। দিবারাত্রি লোকে লোকারণ্য ছিল লঞ্চঘাট এলাকা। লঞ্চের ভেপু বাজানোর শব্দ মাতিয়ে তোলতো আশপাশের এলাকা। পুরো শহরসহ নদীর উত্তরপাড়ের দূরবর্তী কয়েকটি গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তো ভেপুর শব্দ।
বেঙ্গল ওয়াটার কো¤পানির অফিসের স্মৃতিকথা :
এই অফিস ঘরের টিনে বড় অক্ষরে লিখা ছিল বেঙ্গল ওয়াটার কোং। এই লেখাটি নদীর উত্তরপাড় পূর্ব ইব্রাহীমপুর থেকে স্পষ্টভাবে পড়া যেতো। বিশেষ করে জলপথে যাতায়াতকারী সকল যানবাহনে আরোহণকারী মানুষেরা পরিচয় জানতো এই লেখা পড়ে। হাত ইশারা দিয়ে বলতো, এটাই হলো সুনামগঞ্জ শহর।
আশির দশকের লঞ্চঘাটের কথা :
আশির দশকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে লঞ্চ। শূন্যতার হাতছানি পড়ে লঞ্চঘাটে। এরপর আবারও ক্রমান্বয়ে লঞ্চের সংখ্যা ও যাত্রী সাধারণ বাড়তে থাকে। ১৯৯৫ সাল থেকে পুনরায় লঞ্চঘাটের রূপ যৌবন ফিরে পায়। ব্যবসা-বাণিজ্য সবই জমজমাট হয়ে উঠতে শুরু করে। লঞ্চঘাটে ঝুনু মিয়ার লঞ্চ একে এক আসতে থাকে প্রিন্স অব লক্ষ্মীপুর, লাল সাহেব, তমিজ তালুকদার ও মাহফুজ এক্সপ্রেস। সাচনা কোম্পানির আসে জামালগঞ্জ এক্সপ্রেস ও জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। আবারও জমে উঠে লঞ্চঘাট এলাকা।
লঞ্চযাত্রার বিলুপ্তির কারণ :
হঠাৎ লঞ্চ যাত্রী ও লঞ্চের বিলুপ্ত হওয়ার একমাত্র কারণ বলে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের দিকে পাওয়া পা¤প দেশে আসার পর এই ইঞ্জিন মানুষে নৌকায় ব্যবহার করতে শুরু করে। তখন মানুষ নৌকায় আরোহণ করে। মূলতঃ এই ইঞ্জিন সরকার আমদানি করেছিল কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও মানুষ নৌকায় ব্যবহার করতো এই ইঞ্জিন। ইঞ্জিনচালিত নৌকাকে মানুষ বলতেন সেলু নৌকা। এখনও প্রচার আছে সেলু নৌকার।
ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা :
২০০৯ সালের দিকে পরিচ্ছন্ন লঞ্চঘাটের রাস্তা, পন্টুনের আধুনিক সিঁড়ি নির্মাণ। শীতল বাতাস অনুভবের যেন সুরমার উপর নির্মিত সুরম্য পার্ক। লঞ্চযাত্রীদের ব্যাপক আনাগোনা। দিনে ও রাতে জমজমাট লঞ্চঘাট এলাকা। যেন ব্যবসার কেন্দ্রস্থল লঞ্চঘাট। একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের আশা ভাল ব্যবসার জন্য পরিচ্ছন্ন দোকান, পরিচ্ছন্ন খাবার। এমন প্রত্যাশা ছিল ব্যবসায়ীদের।
হঠাৎ লঞ্চঘাটের ভাঙন :
২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর। তখন দেখা দেয় লঞ্চঘাটের রাস্তার ভয়াবহ ভাঙন। নদীতে বিলীন হওয়ার মতো সদৃশ্য ভাঙন নয়, দেবে যাওয়ার মতো ঘটনা। এই ভাঙন শুরু থেকেই পথচারী, ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন রাতে ভাঙন কতটুকু চিহ্ন রেখে যেতেন। সকালে সবার আগে এসে রাস্তা আর কতটুকু দেবে গেল তা প্রত্যক্ষ করতেন। এখনও প্রত্যক্ষ করেন অনেকে। এই ভাঙন পরিলক্ষিত হয় লঞ্চঘাটের ব্যবসায়ী ইদ্রিছ আলীর দোকান থেকে পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত। এই ভাঙন প্রতিরোধে শুরু হয় দায়িত্বশীল মহলের দৌড়ঝাঁপ। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দুইবার পরিদর্শন করতেন দায়িত্বশীলরা। তাঁদের পরিদর্শনের খবরটিও পত্রিকা ও টেলিভিশনে প্রকাশ করা হয়। স্থানীয়দের আশা ছিল শীঘ্রই ভাঙন প্রতিরোধ করা হবে। কিন্তু একটি বাঁশ বা এক নৌকা মাটিও পড়েনি রাস্তায়।
লঞ্চঘাটের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি :
এই ভাঙনে লঞ্চঘাটের রাস্তা ও ব্যবসায়ীদের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। রাস্তা-দোকান-পাট, পন্টুনের সিঁড়ি ভেঙে বিলীন হয়ে যায় নদীতে। দোকানীদের ব্যবসা কমে আসে। হতাশায় পড়েন তারা। ৫০টি দোকানের ব্যবসায়ীরা দারুণ দুশ্চিন্তায় পড়েন। যদিও পন্টুনের সিঁড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে, তবুও পন্টুনে লঞ্চ ভিড়ানো যেতো। যাত্রীরা আসতেন। ব্যবসা করে চলতে পারতেন তারা। একদিন সকালে উজান থেকে ভেসে আসা কার্গো তার অসতর্কতায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সজোরে ধাক্কা মারে পন্টনের গায়ে। তখন লোহার শিকলের বাঁধন ছিঁড়ে চলে যায় অনেক দূরে। তখন পন্টুনের নির্মিত সিঁড়িটিও ভেঙে জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে। এখন পন্টুন বাঁধবে কোথায়? এমন চিন্তায় সবাই। কিন্তু কোনো জনপ্রতিনিধি এই বিপদে ভাঙন রোধে এগিয়ে না আসায় অবশেষে চলে গেল পন্টুন, সাথে নিয়ে গেল সকল লঞ্চ। অনেক দূর, শহরের মল্লিকপুর।
মনের স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকে লঞ্চঘাট। শুধু একা একা পড়ে থাকল ভাঙাচুরা রাস্তা। আবারও ব্যবসায়ীদের দুর্বিষহ জীবন। এই ঘটনার প্রায় ৭ মাস পর পুনরায় স্বস্থানে ফিরে আসে লঞ্চঘাটের পন্টুন। প্রাণ চঞ্চলতা ফিরে পায় লঞ্চঘাট। শুরু হয় আগের মতো ব্যবসা-বাণিজ্য। এখন ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে যাত্রীদের উঠানামার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। আসছে যাত্রী, চলছে লঞ্চ। রাত-বিরাতে জমে প্রাণখোলা আড্ডা।
[লেখক আকরাম উদ্দিন, গবেষক, সাংবাদিক ও গল্পকার]
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ